মাইনুল ইসলাম রাজু, আমতলী ( বরগুনা) থেকেঃ দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে বরগুনার আমতলী- তালতলী উপজেলার সাথে সংযোগকারী একমাত্র বেহাল সড়কটি পুনঃ নির্মাণ ও ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হলেও ঠিকাদারের খামখেয়ালীপনা সড়কটি খুড়ে ফেলে রাখার কারনে ধুলাবালিতে ওই সড়কের দুইপাশে বসবাসরত বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। বর্তমানে সড়কটি ধুলার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। ব্যস্ততম এ সড়কটি সংস্কার কাজে ধীরগতির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে রাস্তার ধুলার কারণে এলাকাবাসীর দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়ায় তাদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। যথা সময়ে ওই সড়কের কাজ সমাপ্তি নিয়েও উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন ওই সড়ক দিয়ে চলাচলরত ভুক্তভোগী মানুষজন।
জানাগেছে, আমতলী- তালতলী- ফকিরহাট পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ওই আঞ্চলিক সড়কটি দিয়ে সোনাকাটা ইকোপার্ক ও শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতে মানুষ যাওয়াত করে। ওই সড়কটিতে আমতলীর মানিকঝুড়ি বাজার থেকে কচুপাত্রা বাজার পর্যন্ত ও কচুপাত্রা বাজার থেকে তালতলী তিন রাস্তা বটতলা পর্যন্ত মিনি পুকুর এবং ১৫ থেকে ২০ গজ দুরত্বে বড় বড় খানাখন্দে ভরপুর থাকায় প্রায় ৪ ধরে বছর বন্ধ রয়েছে ওই দুটি ট্যুরিষ্ট স্পটে পর্যটকদের ভ্রমন। এছাড়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই সড়ক দিয়ে চলাচল করে দু’উপজেলার প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ। প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট বড় দূর্ঘটনা। পথচারী ও এলাকাবাসীকে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। এদিকে ওই সড়ক দিয়ে প্রতিনিয়ত পণ্যবাহি ট্রাক, ভ্যান, ট্রাক্টর, মাহেন্দ্রা, অটোরিকসা, মাইক্রোবাস চলাচল করায় ধুলায় নাকাল হতে হচ্ছে ভূক্তভোগী এলাকাবাসীকে।
গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কের ধুলাবালির সঙ্গে পথচারীদের পাশাপাশি সড়কের পাশে বসবাসকারীদের যেন নিত্য বসবাস। উন্নয়ন কার্যক্রমের নামে সড়কটি খুড়ে কাজ না করার কারণে এবং সড়কে ধুলাবালির পরিমাণ অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় বিষিয়ে উঠেছে পরিবেশ। এ ছাড়াও ওই সড়ক দিয়ে দু’উপজেলার সাধারণ মানুষ, স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শত শত শিক্ষার্থী চলাচল করে থাকে। অন্যদিকে এ সড়কের দু’ধারে গড়ে ওঠা গ্রামবাসীর অবস্থাও নাকাল। সড়কের পাশে গড়ে উঠা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি প্রতিদিন ধুলায় ধূসর হয়ে যায়। যানবাহন চলাচলের সময় পথচারী কিংবা অন্য ক্ষুদ্র যানবাহনে চলাচলকারী যাত্রী সাধারণ ও পথচারীদের চলাচল করতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ সড়ক নির্মাণ কাজে ধীরগতির কারণে শুষ্ক আবহাওয়ায় বাতাসে ধুলাবালি ভাসায় পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করায় পথচারীরা শ্বাসকষ্ট, এলার্জিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
অপরদিকে ওই সড়কটির আড়পাঙ্গাশিয়া নদীর ওপর ১৯৮৫ সালে স্থানীয় প্রকৌশল বিভাগ একটি ষ্টীলের বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করেন। দীর্ঘদিন ওই ব্রীজটি সংস্কার না করায় নরবড়ে হয়ে যায়। একাধিক বার ওই ব্রিজের পাটাতন ভেঙ্গে তালতলী উপজেলার সাখে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সড়কে খানাখন্দ ও নরবড়ে ব্রীজের কারনে গত চার বছর ধরে অভ্যান্তরিণ ও দূরপাল্লার সকল রুটে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই খানাখন্দ সড়ক ও ব্রিজ পার হয়ে ছোট ও মাঝারি যানবাহনে দু’উপজেলার অন্তত আড়াই লক্ষাধিক মানুষের মানুষ যাতায়াত করছে।
দু’উপজেলাবাসীর সীমাহীন দুর্ভোগ লাঘবে গত ২০- ২১ অর্থ বছরের অক্টোবর মাসে বার্ষিক জিওবি মেইনটেনেন্স প্রকল্পের আওতায় ৮ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৩টি প্যাকেজে আমতলী উপজেলার মানিকঝুড়ি বাজার থেকে তালতলী উপজেলার কচুপাত্রা বাজার পর্যন্ত ৮ হাজার ৪০০ মিটার সড়ক পুনঃনির্মাণ এবং ওই সড়কের আমতলীর আড়পাঙ্গাশিয়া নদীতে আইবিআরপি প্রকল্পের আওতায় ৫ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৬০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭.৩ মিটার প্রস্থ্যের একটি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণের দরপত্র আহবান করা হয়। ওই সড়ক পুনঃনির্মাণের কার্যাদেশ পায় ফয়সাল এন্টারপ্রাইজ এবং গার্ডার ব্রিজ নির্মাণের কার্যাদেশ পায় টিএন এন্ড এএসআই (জেভি) নামের ২টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বরগুনা বাস ও মিনিবাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মোঃ ছগির মিয়া সড়ক ও ব্রিজটির নির্মাণ কাজ করছেন।
চলতি বছর জানুয়ারী মাসের প্রথম দিকে কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদার সড়ক পুনঃনির্মাণ ও ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। আমতলীর মানিকঝুড়ি বাজার থেকে কচুপাত্রা বাজার পর্যন্ত সড়কটিতে লাঙ্গল দিয়ে খুড়ে ফেলে রেখেছে। এতে মানিকঝুড়ি বাজারের একাংশ, আড়পাঙ্গাশিয়া বাজার ও তারিকাটা এমপির বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ধুলা বালিতে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ওই সড়কের দু’পাশে বসবাসরত বাসিন্দাদের বসত বাড়ীতে বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
২৮ মার্চ সোমবার সরেজমিনে ওই সড়ক পুনঃনির্মাণ ও ব্রিজ নির্মাণ কাজ দেখতে গিয়ে দেখা যায়, সড়ক ও ব্রিজের নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। সড়কটি লাঙ্গল দিয়ে খুড়ে ফেলায় ইটের সুরকী ও বালু বাতাসে উড়ে দোকানপাট ও বসত বাড়ীতে গিয়ে পড়ছে। সড়কের পাশের গাছ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সড়কের পাশে বসবাসকারীদের বাড়ীঘর ধুলাবালি পড়ে লালচে রং ধারণ করছে। এছাড়া ওই সড়কে চলাচলরত মাহেন্দ্রা অটোরিকসা ও মোটরসাইকেলে চলাচলরত যাত্রীরা ধুলাবালিতে একাকার হয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়ছে।
শুরুতে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ায় দু’উপজেলার মানুষের মাঝে স্বস্থি ফিরে এলেও দরপত্রানুসারে যথা সময়ে নির্মাণ কাজ শেষে হওয়া নিয়ে এখন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন ওই সড়ক দিয়ে চলাচলরত ভুক্তভোগী মানুষজন। সামনে বর্ষা মৌসুমে আমতলী- তালতলী সড়কপথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে তারা আশংকা প্রকাশ করছেন।
কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী নিপা বিশ্বাস বলেন, সড়কটির পুনঃ নির্মাণের কাজ ফেলে রাখায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কলেজে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে সড়কে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গায়ের জামা-কাপড় ইটের ধুলাবালিতে ধূসর হয়ে যায়। নাক-মুখ বন্ধ হয়ে আসে। চোখে ধুলা পড়লে তো আর ভোগান্তির শেষ নেই।
আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডাঃ আব্দুল মুনয়েম সাদ বলেন, ক্ষতিকর উপাদান ও রোগজীবাণু মিশ্রিত ধুলাবালি মানবদেহে প্রবেশ করলে এলার্জি ও শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগের সৃষ্টি করে থাকে। মারাত্মক বায়ুদুষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি স্বরূপ।
মানিকঝুড়ি বাজারের ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদ ফকির বলেন, সড়কটি খুড়ে ফেলে রাখায় ব্যবসায়ীরা চরম ভোগান্তিতে আছে। দোকানের সামনে কাপড় টানিয়েও সড়কের ধুলাবালি থেকে দোকানঘর রক্ষা করা যাচ্ছে না। সড়কের খোয়ার সৃষ্ট ধুলায় জনজীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
আড়পাঙ্গাশিয়া বাজারের ব্যবসায়ী সরোয়ার হাওলাদার, আঃ রাজ্জাক মৃধা, আবুল কালাম বলেন, সড়ক ও ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু করায় এলাকাবাসী খুশি হলেও ঠিকাদার সড়কটি খুড়ে ফেলে রেখে ও ব্রিজ নির্মাণ কাজ বন্ধ করে রাখায় বাজারের ব্যবসায়ীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রাস্তার ধুলাবালিতে বাজারের দোকানপাটগুলো একারকার হয়ে যাচ্ছে। ঠিকাদারকে সড়কে পানি দিতে বললেও তিনি সেটা দিচ্ছেন না।
তালতলী উপজেলার সিনিয়র সাংবাদিক মোঃ ইউসুফ আলী বলেন, বেহাল আমতলী- তালতলী আঞ্চলিক সড়কটি পুনঃনির্মাণ ও ব্রীজের নির্মাণ দুই উপজেলাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবী ছিলো। কিন্তু ঠিকাদারের খামখেয়ালিপনায় সড়কটি পুনঃনির্মাণের জন্য খুড়ে ফেলে কাজ রাখায় এখন ওই সড়ক দিয়ে মানুষের চলাচলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। প্রতিদিন ওই সড়কে ছোট বড় দূর্ঘটনা ঘটছে এবং চলাচলরত মানুষজন ধুলাবাতিতে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তাই দ্রুত সড়কটির কাজ শুরু ও শেষ করার জোর দাবী জানাই।
তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ রেজবী উল কবির জোমাদ্দার মুঠোফোনে বলেন, আমতলী- তালতলী সড়কটি পুনঃনির্মাণের জন্য ঠিকাদার সড়কটি খুড়ে ফেলে কাজ বন্ধ রাখায় জনদুর্ভোগে পড়েছে দু’উপজেলার প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ। ঠিকাদারকে দ্রুত সড়কটির কাজ শুরু ও নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য আমি বরগুনা এজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানিয়েছি।
আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন আমতলী- তালতলী আঞ্চলিক সড়কটি পুনঃনির্মাণের জন্য লাঙ্গল দিয়ে খুড়ে ফেলে রাখা ও ব্রিজটির নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, সড়ক ও গার্ডার ব্রিজের নির্মাণ কাজ দরপত্রানুসারে শুরু করে অজ্ঞাত কারনে ঠিকাদার ওই কাজ বন্ধ করে রেখেছেন। ঠিকাদারকে দ্রুত কাজ শুরু করতে ও নির্দ্দিষ্ট সময়ে শেষ করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। আশাকরি যথা সময়েই ওই কাজ শেষ হবে এবং কাজ শেষ হলে দু’উপজেলার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন হবে।
সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণের ঠিকাদার মোঃ সগির হোসেন মুঠোফোনে সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণ কাজ ফেলে রাখার কথা স্বীকার করে বলেন, কার্যাদেশ অনুযায়ী সময়সীমার মধ্যে সড়ক ও ব্রিজের নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে।
বরগুনা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী সুপ্রিয় মুখার্জি মুঠোফোনে বলেন, আমি সম্প্রতি বরগুনায় যোগদান করেছি। আমি ওই সড়ক ও ব্রিজটির বিষয় যেনে দ্রুত ঠিকাদারকে কাজ শুরু করার জন্য তাগিদ দিবো এবং কার্যকরী ব্যবস্থা নিবো।
এ বিষয়ে আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একেএম আব্দুল্লাহ বিন রশিদ মুঠোফোনে বলেন, এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে সড়ক ও ব্রিজের কাজ দ্রুত শেষ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।