ওসি মানিক ১৯ বছরে যা আকাম-কুকামা করায় শেষ পরিনতি

1
122

এম এ কাদেরঃ কথায় আছে চুরের নিত নিত সাওদের এক দিন। চুলর মাউগের বড় গলা খায় শুধু দুধ কলা। যদি হয় প্রশাসনওয়ালা ঠেকায় আবার কোন হালা। অপরাধীদের একদিন না একদিন লইতে হয় ঠেলা। এবার বুঝতেছে মানিক ওয়ালা।

চাকুরী করেন পুলিশে। কর্মজীবনে শৃঙ্খলাপরিপন্থি কাজ করেছেন অসংখ্যবার। যার বেশির ভাগ গুরুতর অপরাধ। অথচ অজ্ঞাত জাদুর কাঠির বলে প্রতিবারই গুরুদণ্ড তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

সর্বনিম্ন সাজা হয়েছে ‘তিরস্কার’। তবে তা একবার-দুবার নয়-১৩ বার। যেসব অপরাধে তার চাকরিই থাকার কথা নয়, সেখানে তাকে ইনস্পেকটর পদে পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। হবিগঞ্জে ডিবির এস আই পদে থাকাবস্থায় ২০১২ সালে ‘সিম ডট কম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির তথ্য দিয়ে কানাডায় যেতে স্টুডেন্ট ভিসাও চেয়েছিলেন।

 

 

এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামে সনদও জাল করেছেন। এসব জাল সনদ শিক্ষাগত যোগ্যতায় অন্তর্ভুক্ত করে নিজেকে মেধাবী হিসাবে জাহির করতেন। এভাবে নিজেকে উচ্চশিক্ষিত সাজানোর পাশাপাশি একাধিক বিয়েও গোপন করেছেন। প্রয়োজন অনুযায়ী জন্মসনদ ব্যবহার করেন দুটি। ভয়ংকর এই পুলিশ কর্মকর্তার নাম মানিকুল ইসলাম মানিক। বিপি নং ৭৮০৪০৯৯১৩৭।

 

 

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মানিকুল ইসলাম মানিকের একে একে বিচিত্র প্রতারণায় নারীর সম্ভ্রমহানির এমন তালিকা এখন অনেক দীর্ঘ। যেখানে চাকরি করেছেন, সেখানেই তার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অগণিত নারী। এ ধারাবাহিকতায় সিলেটের প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য প্রবাসী পাত্রীও সর্বস্ব হারিয়েছেন।

 

 

একাধিক বিয়ে গোপন করে তাকে বিয়ে করেন এই মানিক। আবার পুলিশ সদর দপ্তরে সংরক্ষিত ব্যক্তিগত তথ্যবিবরণীতে তাকেই স্ত্রী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছেন। প্রতারণার শিকার প্রবাসী ভিকটিমের বিস্তর অভিযোগের সত্যতা পেয়ে মানিককে সাময়িক বরখাস্ত করে বরিশাল পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়।

মানিকের পাশবিক নির্যাতনের স্বীকার কয়েক তরুণীর বোবা কান্না পুলিশের ভাবমূর্তিকে চরমভাবে আঘাত করেছে। এছাড়া মাদক ও চোরাই গাড়ির ব্যবসা ছিল তার অবৈধ আয়ের উৎস। চোরাই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সহযোহিগতায় থাকলেও বরাবরই নিজেকে আড়াল করার সুযোগ পেয়েছেন। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে সর্বনাশা এই মানিকের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে এসেছে।

 

 

প্রবাসী ভিকটিমের বড় ভাই আব্দুল হাকিম যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ইনস্পেকটর মানিকের প্রতারণা সহ্য করতে পারেননি তার বোন। পুলিশ সদস্য হয়ে এভাবে একজন মানুষ প্রতারণা করতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারেননি।

কয়েকটি বিয়ে গোপন এবং অগণিত নারীর সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি জানতে পেরে তার বোন মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। বিদেশের মাটিতে তার স্বাভাবিক চলাফেরা, আচার-আচরণে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করছি। তীব্র মানসিক কষ্ট থেকে নিজেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধানসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন তিনি।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, মানিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তা তদন্তে কয়েকটি টিম কাজ করছে। তবে কানাডায় যেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামে জাল সনদ তৈরির বিষয়টি অধিক গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া নারী নির্যাতনের বিষয়ে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তদন্ত শেষ করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

 

এদিকে সিঙ্গাপুরে কানাডিয়ান ভিসা সেন্টারে ইমিগ্রেশন পুলিশের গোপন নজরদারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদ জমা দেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। এরপর থেকে সিঙ্গাপুরে কানাডিয়ান ভিসা সেন্টারে মানিকুল ইসলামকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।

২০১৫ সালে পরিবারের ১১ সদস্যসহ কানাডায় যেতে আবেদন করেন মানিকুল ইসলাম। এর আগে আরও দুবার ভিসা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন তিনি। ওই আবেদনে উপস্থাপিত সার্বিক তথ্য-উপাত্তে মানিকুল ইসলাম কানাডায় পাড়ি জমাতে দুবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বিষয়টি গোপন করেন।

মূলত এমন আলামত পেয়েই কানাডার ইমিগ্রেশন পুলিশ মানিকুল ইসলামকে রেড মার্কে রেখে নজরদারির আওতায় নেয়। এরপরই একে একে বেরিয়ে আসে মানিকুল ইসলামের ভয়াবহ জালিয়াতির বিষয়টি। নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৫ সালে কানাডা যেতে আবেদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভিসা সেন্টারের প্রয়োজনীয় কিছু নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করেন মানিকুল ইসলাম।

সেখানে তিনি শিক্ষাগত যোগ্যতার ছকে উল্লেখ করেন ১৯৯৫ সালে রাজশাহীর চন্দনকাঠা হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞানে এসএসসি, ১৯৯৭ সালে গোদাগাড়ি কলেজ থেকে মানবিকে এইচএসসি, ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএসএস, ২০০৩ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় ও একই বিষয়ে মাস্টার্স এবং ২০০৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স (ইউআইটিএস) থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন।

 

 

এই আবেদনে তিনি পুলিশে চাকরি করার তথ্য দেন। সিঙ্গাপুরে কানাডার ভিসা সেন্টার অনুসন্ধান করে তার এসব তথ্য জালজালিয়াতি করার প্রমাণ পায়। পুলিশের আইজির কাছে দেওয়া অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা সরেজমিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে খোঁজ নেয়। এসময় মানিকের নামে উত্থাপিত এসব সনদের কোনো অস্তিত্ব পায়নি।

কানাডা ভিসা সেন্টারে জমা দেওয়া প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সনদ জাল বলে প্রমাণিত হয়। এরপরও তার চাকরি আছে বহাল তবিয়তে।

নারীর সম্ভ্রমহানি : নারীর সম্ভ্রমহানির তালিকা এতই লম্বা যে, হবিগঞ্জের একটি থানায় ওসির দায়িত্বে ছিলেন-এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘না হলেও অন্তত একশ নারীর সম্ভ্রম লুট করেছেন এই মানিকুল ইসলাম। অভিযোগ দেওয়া হলে ভয়ভীতি দেখিয়ে আপস করার চেষ্টা করেছেন তিনি।

আবার কোনো কোনো ভিকটিমকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেছেন। এভাবে এই মানিকুলের কারণে পুলিশের ইমেজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ ওই ওসির একটি অডিও রেকর্ড যুগান্তরের কাছে আসে। এতে বলতে শোনা যায়, মানিকুল ইসলাম হবিগঞ্জে থাকাবস্থায় তৎকালীন তিন পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহ, সেলিম ও রবিউলের আশকারা পেয়ে যা ইচ্ছা তাই করেছেন।

 

 

দীর্ঘ অডিওতে এক জায়গায় ওই ওসিকে বলতে শোনা যায়, ‘শায়েস্তাগঞ্জে স্বপন নামে এক মাতালকে ৫শ ইয়াবাসহ গ্রেফতার করেছিলাম। অথচ এই মাতালের দুই বোনের সঙ্গে মানিকুল ইসলাম অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাদের একজন মানিকের সেকেন্ড ও অপরজন থার্ড স্ত্রী হিসাবে পরিচিত।’ এই ঘটনা শায়েস্তাগঞ্জের সবাই জানে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে এই ওসি নিজেও সাক্ষ্য দিয়েছেন।

নথিপত্রে দেখা যায়, হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের একজন ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগে মনিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে তৎকালীন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্লাহর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে ইনস্পেকটর মানিকের সার্বক্ষণিক সহযোগী গাড়ি চোরচক্রের সক্রিয় সদস্য দুর্ধর্ষ তারেক মিয়াকেও অভিযুক্ত করেন। ওই ব্যবসায়ীকে ক্রসফায়ারের হুমকিও দেন মানিক।

গুরুতর এমন অভিযোগ পেয়েও তার বিরুদ্ধে ওই সময় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে ভয়ে বিষয়টি আপস-মীমাংসা হলেও ইউসুফ আলী আর ওই স্ত্রীকে ঘরে তুলতে পারেননি। সম্প্রতি তারেককে গাড়ি চুরির মামলায় রাজধানীর কাফরুল এলাকা থেকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে। দুর্ধর্ষ এই তারেক জেলহাজতে থাকলেও তার সহযোগী মানিক চাকরিতেই আছেন।

এছাড়া সিরাজগঞ্জে থাকাবস্থায় একজন পৌর কাউন্সিলরের স্ত্রীকেও ভাগিয়ে নিয়ে চলে আসেন মানিক। ওই বিষয়টিও আপস-মীমাংসা করা হয়। সিলেটের একজন ফিজিও থেরাপিস্টকে ধর্ষণের চেষ্টাও করেছেন। ওই ঘটনার পর ভিকটিমের সংসারও ভেঙে গেছে। ওই ফিজিও থেরাপিস্ট এ বিষয়ে সিলেট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাও করেছেন।

মামলাটি এখন তদন্ত করছেন বালাগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শরীফ নিয়ামত উল্লাহ। হবিগঞ্জের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের একজন নার্সের সম্ভ্রমহানিও করেছেন। লোকলজ্জার ভয়ে তিনি কোনো অভিযোগই করেননি।

কুকর্মের সাক্ষী ভাই দীর্ঘ অনুসন্ধানে এই নারীলোভী মানিকুল ইসলামের অপকর্মের রাজসাক্ষী তারই এক চাচাতো ভাইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই যুবক বলেন, ‘মানিকুল ইসলাম কীভাবে টাকা কামাই করেন, তা সবাই জানেন। ওপরদিকে থুতু ফেললে নিজের ওপরই পরে। তার (মানিকুল) এই অবৈধ টাকা কামানোর তালিকায় আমিও ছিলাম। তখন আমি বুঝতে পারিনি।

না বুঝেই অনেক কাজ করে ফেলিছি। মানিকুল ইসলামের বিয়ে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিয়ে যে কয়টা করেছে আর কয়টা ওর বউ, তা ১, ২, ৩, ৪ হিসাব করে বলতে হবে। তিনি এমন মেয়েকেই বিয়ে করেন বা প্রতারণার মাধ্যমে সম্ভ্রম লুট করেন, যার প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ বা শক্তি নেই। আক্ষেপ করে এই যুবক বলেন, ‘মানিক এমনই একজন বড় ভাই, যে ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে সম্পত্তিও আটকে রাখেন।’

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে ওই যুবক বলেন, ‘বড় ভাইয়েরা সব সময় বলেন-স্ত্রী নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকো। আর মানিকুল এমনই এক ভাই, যে কিনা আমাকে দিয়ে খারাপ কাজ করানোর জন্য আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে বলেছেন। কারণ আমার স্ত্রী ছিলেন শিক্ষিত। খারাপ কাজ করতে বাধা দেবে, এ কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে বলেছেন। তার এ কথা না শোনায় মনে মনে প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন।

আমার একটা জমিও তিনি নিয়ে নেন। একসময় বলতে থাকেন, বউ ছেড়ে দাও, নাহলে সম্পত্তিও পাবে না।’ সেই স্ত্রীও এখন আমার সঙ্গে নেই। ঠিকই ছাড়াছাড়ি হয়েছে।

গুরুতর অভিযোগেও তিরস্কার : তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৭ বছরের চাকরিজীবনে মানিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে গুরুতর ১৩টি অভিযোগ প্রমাণ পেয়েছেন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা, যা আইন প্রয়োগকারী একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু বারবার তাকে সর্বনিম্ন সাজা ‘তিরস্কার’ করে অভিযোগের সব ফাইল ধামাচাপা দেওয়া হয়। অথচ যেসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তা আমলে নেওয়া হলে তার চাকরিই থাকার নয়।

মানিকুল ইসলামের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার শ্রীমন্তপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আবুল কাশেম। ২০০৪ সালের ১ নভেম্বর এসআই (নিরস্ত্র) পদে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন মানিকুল ইসলাম। বিএনপির তৎকালীন মন্ত্রী রাজশাহীর আমিনুল ইসলামের তদবিরে তার চাকরি হয়। এই পদে তার প্রথম পোস্টিং রাজশাহী মহানগরীর রাজপাড়া থানায়। এরপর ২০০৭ সালের ১৪ আগস্ট সিলেট রেঞ্জে বদলি হয়ে আসেন।

এর দুইদিন পরই হবিগঞ্জের মাধবপুর থানায় এসআই হিসাবে যোগদানও করেন। ২০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল তাকে বদলি করা হয় সিলেট জেলা ডিএসবিতে। এরপর হবিগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, আবারও সিলেট ডিএসবি, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ, ডিবি, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ পুলিশ লাইনস, রাজশাহী রেঞ্জ অফিস, সিরাজগঞ্জ ডিবি ও রংপুর রেঞ্জ অফিসে কর্মরত ছিলেন। ১৭ বছরের চাকরিজীবনে তিনি প্রশংসা পেয়েছেন একটি।

আর তিরস্কার পেয়েছেন ১৩ বার। ২০০৭ সালে মানিকুলের ঝুলিতে প্রথম তিরস্কারের তকমা যোগ হয়, তখন তিনি হবিগঞ্জের মাধবপুরে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সময়ে কর্মরত একজন সহকর্মী  বলেন, অহেতুক ওয়াকিটকি নিয়ে ঘোরাফেরা করতেন মানিকুল ইসলাম। বিশেষ করে মেয়েদের দেখলেই তিনি ওয়াকিটকি নিয়ে অঙ্গভঙ্গি করতেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হবিগঞ্জের মাধবপুরে কর্মরত থাকাবস্থায় ২০০৭ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অহেতুক ওয়াকিটকি দিয়ে প্রেম করায় তার কাছে কৈফিয়ত তলব করা হয়। এ ঘটনায় ২৯ মে তাকে তিরস্কার করা হয়। একই থানায় থাকাবস্থায় একই বছরের ২৬ নভেম্বর তৎকালীন পুলিশ সুপারের নির্দেশ অমান্য ও দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে তাকে দ্বিতীয়বার তিরস্কার করা হয়।

২০০৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তৃতীয়বার তিরস্কার পান। মাধবপুর থানার মামলার (নং ১৬(৮) ২০০৮) আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিলে গড়িমসির কারণে চতুর্থবার তিরস্কার করা হয়। ২০০৯ সালের ৯ জুলাই থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওয়ারেন্ট তামিল সন্তোষজনক না হওয়ায় পঞ্চমবারের মতো তিরস্কার করা হয়। একই বছরের ২৬ নভেম্বর ৪ মাসের গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিলে ব্যর্থতার কারণে ষষ্ঠবার তিরস্কার পান।

২০১০ সালে সিলেটের ওসমানীনগর থানায় কর্মরত থাকাবস্থায় ৮ মার্চ অদক্ষতার কারণে ৭ম তিরস্কার করা হয়। একই থানায় থাকাবস্থায় ২০১০ সালের ২২ মার্চ অষ্টমবার তিরস্কার পান। সিলেট সদর থানায় ২০০৯ সালের ২ জানুয়ারি দায়ের করা ৪নং মামলাটি তদন্তের দয়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। ওই মামলাটি তদন্তে গাফিলতির প্রমাণ পান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এই অভিযোগে তার কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়।

জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় নবম তিরস্কার করা হয় তাকে। ২০১২ সালের ৮ মার্চ সিলেট মডেল থানার একটি অভিযোগ (স্মারক নং ১৬৩৭) তদন্তের পর প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনটি অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জানা যায়, মানিকুল ইসলাম ফোর্সদের অসভ্য ভাষায় গালগাল করেন। এমন গুরুতর অভিযোগ প্রমাণের পরও তাকে ১০ নম্বর তিরস্কার করা হয়।

মানিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভয়াবহ গুরুদণ্ডের ৩টি অভিযোগ পাওয়া যায় সিরাজগঞ্জে। ২০১৪ সালের ১৩ জুলাই সিরাজগঞ্জ থানায় দায়েরকৃত ৩৮নং মামলাটি তদন্ত করেন তিনি। এ সময় আসামিদের পক্ষ নিয়ে কাজ করার অভিযোগ ওঠে। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার গাফিলতির প্রমাণ পান। মানিকুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট মামলার কোনো আসামিকে গ্রেফতার না করে চার্জশিট দাখিল করে ১১ বারের মতো তিরস্কার পান ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি।

২০১৪ সালের ১ আগস্ট দায়ের করা ৩নং মামলার চার্জশিট দখিল করেছেন মূল আসামিদের বাদ দিয়ে। সংশ্লিষ্ট মামলাটির প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের জবানবন্দি অনুযায়ী সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ না করে মূল আসামিদের হত্যার দায় থেকে বাঁচাতে চার্জশিট দেওয়া হয়।

এরপর বিশ্বাসভঙ্গের এমন গুরুতর অভিযোগ এনে ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর ১২ নম্বর তিরস্কার করা হয়। ১৩নং তিরস্কারটিও আসে সিরাজগঞ্জ সদর থানায় কর্মরত অবস্থায় ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। অথচ সর্বশেষ তিরস্কার পাওয়ার ৮ মাসের মাথায় ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর পদোন্নতি পেয়ে ইনস্পেকটর হয়েছেন এই মানিকুল ইসলাম।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে পরিদর্শক (সাময়িক বরখাস্ত) মানিকুল ইসলামের সঙ্গে ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সংযোগ স্থাপন করেননি। পরে অভিযোগের সারসংক্ষেপ উল্লেখ করে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে তার বক্তব্য চাওয়া হয়। কিন্তু তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। (সূত্র: দ,জ, এস)

ওসি মানিকের সকল অপকর্মে সংবাদ জানতে শিরোনাম গুলো গুগলে সার্চ করুন

ওসি মানিকের অপকর্মের শেষ কোথায়

যা যা করল ওসি মানিক জানতে শিরোনাম গুলো একবার গুগলে বসিয়ে জানুন সব কিছু

 

১৬ নভেম্বর ২০২১ সালে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তরের সংবাদ

ওসি মানিকের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন, বাদীর নারাজি

(পূর্বে প্রকাশিত সংবাদ)

সিলেটের আদালতে বিচারাধীন ডিবির ওসি মানিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে করা মামলায় দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দিয়েছেন মামলার বাদীপক্ষ। সিলেটে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে মঙ্গলবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ওসমানীনগর উপজেলা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা নাজমা বেগম।

অভিযুক্তকে রক্ষা করতে একপেশে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়- এমন দাবি করে বাদীপক্ষের আইনজীবী দাখিলকৃত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দিয়ে পুনঃতদন্তের আবেদন করেন। আদালত এ আবেদন গ্রহণ করলেও শুনানি হয়নি। সিলেট বারের একজন আইনজীবী মারা যাওয়ায় সংক্ষিপ্ত সময় বিচারকাজ চলে। পরবর্তীতে আদালত শুনানির তারিখ নির্ধারণ করবেন বলে জানান বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোশাহিদ আলী।

তিনি যুগান্তরকে জানান, চলতি বছরের ২০ জুন ট্রাইব্যুনালের বিচারক সিনিয়র জেলা জজ মো. মুহিতুল হক এনাম চৌধুরীর আদালতে মামলাটি আমলে নিয়ে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ওসমানীনগর উপজেলা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একাধিকবার আদালতে সময় চেয়ে দীর্ঘ প্রায় ৫ মাস পর অভিযুক্তকে রক্ষা করে একপেশে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। যার ওপর মামলার বাদী নারাজি দিয়েছেন এবং পুনঃতদন্তের আবেদন করেছেন।

উল্লেখ্য, হবিগঞ্জ জেলা ডিবির সাবেক ওসি মানিকের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ২০ মার্চ সিলেটে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন ওসমানীনগরের এক তরুণী।

মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, হবিগঞ্জে কর্মরত থাকাকালীন অভিযুক্ত মানিক ওসমানীনগর উপজেলার তাজপুর কদমতলা এলাকায় বডি ম্যাসেজ করতে তাহলিল ফিজিওথেরাপি সেন্টারে প্রায়ই যেতেন। সেখানে পরিচয় হয় ফিজিওথেরাপিস্টের সহকারী এক তরুণীর সঙ্গে।

সাবেক ওসি মানিকের বিরুদ্ধে  তরুণী ধর্ষণের চেষ্টা  – মামলা দায়ের

মানিক ওই তরুণীকে বিভিন্ন সময় অসামাজিক কাজের প্রস্তাব দিতেন। মানিক তরুণীকে অশোভন ইঙ্গিত, অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে জীবন দুর্বিষহ করে তোলেন। পরে ১৫ জানুয়ারি রাত ৯টায় পরিকল্পিতভাবে থেরাপি রুমে প্রবেশ করে তরুণীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন।

আদালত থেকে তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওসমানীনগর উপজেলা আনসার ও ভিডিপির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজমা বেগম নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দেননি। বাদীর অভিযোগ একাধিকবার আদালতে সময় চেয়ে সময়ক্ষেপণ করেছেন।

সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আদালত থেকে বিলম্বে পাওয়ায় সময় নিয়েছেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তা দাবি করেন। তবে একাধিকবার বাদীকে অফিসে ডেকে নিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা চাপ দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন বাদী। এ ব্যাপারে জানার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি।

এছাড়াও ওই তরুণী ঘটনার প্রতিকার চেয়ে পুলিশের আইজির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগটি আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার। ইতোমধ্যে তরুণীর বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দল সিলেটে গিয়ে ভুক্তভোগী তরুণীর সাক্ষ্য-প্রমাণাদি গ্রহণ করে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নির্যাতনের শিকার তরুণী।

 হবিগঞ্জ ডিবি’র সাবেক ওসি ও বর্তমানে রাজশাহী রেঞ্জের সিরাজগঞ্জ জেলায় কর্মরত ডিবি’র ওসি মানিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে সিলেটে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছে। রোববার (২ আগস্ট) এসব তথ্য নিশ্চিত করেন মামলার বাদী এক তরুণী (২৭)। এর আগে চলতি বছরের ২০ মার্চ সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক সিনিয়র জেলা জজ মো. মুহিতুল হক এনাম চৌধুরীর আদালতে এ মামলাটি দায়ের করেন সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার তাজপুর এলাকার ওই তরুণী।
সাবেক ওসি মানিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
বিচারক মামলাটি ৭ কার্যদিবসের মধ্যে অনুসন্ধানপুর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য উপজেলা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তাকে নির্দেশ প্রদান করেন। মামলা ও ভূক্তভোগী সূত্রে জানা যায়, হবিগঞ্জে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে অভিযুক্ত মানিকুল ইসলাম ওসমানীনগর উপজেলার তাজপুর কদমতলা এলাকায় বডি মেসেজ করতে তাহলিল ফিজিও থেরাপী সেন্টারে প্রায়ই যাওয়া আসা করতেন। সেখানে পরিচয় হয় ফিজিও থেরাপিস্ট এর সহকারী সুন্দরী ঐ তরুণীর সাথে। ওই সুন্দরী  ফিজিও থেরাপী সেন্টারে থেরাপিস্ট এর সহকারী পদে অনুমান ৪ বছর ধরে কর্মরত।
হবিগঞ্জে দায়িত্বের ফাঁকে মানিকুল ইসলাম তাজপুরে আত্মীয়তার সুবাদে প্রায় সময়ই তাজপুর গিয়ে ফিজিও থেরাপী সেন্টারে বডি ম্যাসেজ করতে কাষ্টমার হিসেবে আসা যাওয়া করতেন। এরই মধ্যে ওসি ডিবি মানিকুল ইসলামের কুনজর পড়ে সুন্দরী নারীর উপর। মানিকুল ইসলাম ওই নারীর সাথে বিভিন্ন সময় তাকে অসামাজিক কাজের প্রস্তাব দিতে থাকেন। ওই নারী তার এহেন আপত্তি জনক আচরণের প্রতিবাদ করেন এবং  ফিজিও থেরাপী সেন্টারের পরিচালকে  অবগত করেন। এরপর থেকে মানিকুল ইসলাম তরুণীর প্রতি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বিরক্ত করাসহ কুইঙ্গিত, কুপ্রস্তাব করে জীবন দুর্বিসহ করে তুলে।
এরই মধ্যে ১৫ জানুয়ারি শুক্রবার রাত অনুমান ৯টার সময় পরিকল্পিতভাবে থেরাপীরুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করেন মানিকুল। তরুণীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করার জন্য ঝাপটাইয়া ধরে থেরাপী রুমের বেডে ফেলে দেন। তরুণী চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করলে মানিকুল ইসলাম পুনরায় মুখ চেপে ধরে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করতে উদ্যত্ত হন। তরুণী বলেন, ওসি ডিবি মানিকুল ইসলাম আমার পড়নের কাপড়-চোপড় টানিয়া অর্ধউলঙ্গ করিয়া ফেলে এবং মুখ চাপারত অবস্থায় আমার উপর চলতে থাকে মানিকুলের উপর্যুপরি এক পাশবিক অত্যাচার।
এমনকি আমার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে আমার আর্তচিৎকারে মানিকুলের হাত আমার মুখের উপর থেকে সরে যায়। এতে মানিকুল ইসলাম আমাকে চর-থাপ্পর মেরে পালিয়ে যায় । পরবর্তীতে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নিকট বিচারপ্রার্থী হলে উক্ত ফিজিও থেরাপী সেন্টারে পরিচালক তার নিজ দায়িত্বে  বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দিবেন মর্মে আশ্বস্ত করেন ওই তরুণীকে । কিন্তু ওসি মানিকুল ইসলাম তার ক্ষমতার অপব্যবহার দেখিয়ে বিচার সালিশ না মেনে সময়ক্ষেপন করতে থাকেন । অবশেষে ওই তরুণী থানায় মামলা করতে গেলে থানা পুলিশ তার মামলা নেয়নি। পরে তিনি বাদী হয়ে সিলেট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মানিকুলের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (২০০৩ সালের সংশোধিত) এর (৯) ৪ ( খ) – ধারা মোতাবেক মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং ৩৬২-২১ইং ।
এছাড়া ওই নারী পুলিশের আইজিপি ও রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি ও সিরাজগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এর আগে ২০২০ সালের ২০ আগস্ট মানিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার ইউসুফ আলী নামের এক ব্যবসায়ী তার স্ত্রীর সাথে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক ও তার কাছে চাঁদা দাবী এবং হত্যার হুমকীর অভিযোগ তুলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজিসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেন।
ওসি মানিকের ক্রসফায়ারের ভয়ে সাংবাদিক সম্মেলনও করে ইউসুফ আলী। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে চোরাকারবারি, জালিয়াতি, প্রতারণাসহ রয়েছে একাধিক নারী কেলেঙ্কারীর অভিযোগ। কিছু অভিযোগ  তদন্তাধীন ও কিছু বিচারাধীন রয়েছে বলে সংশিষ্টরা জানিয়েছেন। গত ১৭ জুলাই বিকেলে তার বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে ৫ সদস্য বিশিষ্ট  প্রতিনিধিদল তদন্ত করতে সিলেটে আসেন এবং ভুক্তভোগী তরুণীর সাক্ষ প্রমাণাদি গ্রহন করেন। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামসুন্নাহারের কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন- তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগটা ডিসিপ্লেন ২ শাখা অনুসন্ধান করছে। জানতে চাইলে  তরুণীর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপজেলা আনসার ও ভিডিপির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজমা বেগম বলেন, কাগজপত্র আসছে  নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে  প্রতিবেদন দাখিল করা হবে ।

চোরের হাতে নিলামের কাগজ : তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, উজ্জ্বল ওরফে হৃদয় মাধবপুর উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা পরিচয়ে চলাফেরা করেন। আর এএইচ রুবেল নিজের চৌর্যবৃত্তি আড়াল করতে সম্প্রতি হবিগঞ্জের একটি দৈনিক পত্রিকা কিনে নিজেই ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছেন। মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে সব ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তারা। নিলামের জাল নথিপত্র দিয়ে ৫টি গাড়ি চালানোর প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। গাড়িগুলো হচ্ছে সবুজ রঙের প্রাইভেট কার চেসিস নং এই১১০-৫১৪২৮৯২, সিলভার রঙের প্রাইভেট কার ঢাকা মেট্রো-গ-২৫-৫০৭৪ চেসিস নং এনজেডই১২১-৩২৫৬৪৪২, নীল রঙের প্রাইভেট কার ঢাকা মেট্রো গ-১১-৪৯৬৮ চেসিস নং এসটি১৯০-০০০৩৩৬৯, সিলভার রঙের প্রাইভেট কার ঢাকা মেট্রো খ-১২-৭৬৯১ চেসিস নং এনজেডই ১২০৩০৬৭৬৪৭ এবং সিলভার রঙের প্রাইভেট কার ঢাকা মেট্রো গ-২০-৯৮৮৯ চেসিস নং ডব্লিউওএলওজেডসিএফ ৬৮৭১০৭০৮৬৩। উজ্জ্বল ওরফে হৃদয় পাঠান ও এএইচ রুবেল বলেন, চশমা তারেকের কাছ থেকে গাড়ি নিলামে নিয়ে তারা ফেঁসে গেছেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তারেক যে তথ্য-উপাত্ত দিয়েছেন, এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই।

ডিবিপ্রধান যা বললেন : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান ডিআইজি মেহাম্মদ হারুনুর রশীদ বলেন, ‘হবিগঞ্জে অবৈধভাবে চোরাই গাড়ি নিলাম করার প্রক্রিয়া নিয়ে চশমা তারেক যে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন, তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। চশমা তারেক স্পর্শকাতর কিছু তথ্য দিয়েছেন, যা তার দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নেই। তার দেওয়া তথ্যগুলো নিয়ে শীর্ষ মহলে কথা বলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।’

প্রসঙ্গত, গত ২৮ মে ‘গুরুতর অপরাধেও সাজা তিরস্কার, আটকায়নি পদোন্নতি, মানিক এখন পরিদর্শক’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া এই মানিকুল ইসলামকে বর্তমানে বরিশাল রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়েছে।

ডিবির সাবেক ওসি মানিক ও চশমা তারেক
হবিগঞ্জ ডিবির সাবেক ওসি মানিকের
সহযোগিতায় গাড়ি চুরির সিন্ডিকেট : চশমা তারেকের সম্পৃক্ততায় আদালতের কম্পিউটার অপারেটর আল আমিন কোটিপতি। চোরাই গাড়ির সিন্ডিকেটের মূল হোতা হবিগঞ্জ শহরের চশমা
তারেক। বিষয়টি কারো অজানা নয়। তবে তার সাথে হবিগঞ্জের সাবেক ডিবি’র ওসি মানিকুল ইসলাম মানিক ও আদালতের কাম কম্পিউটার অপারেটর আল আমিনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানেন না কেউ। তাদের একে অপরের সহযোগিতায় আদালতে বসানো হয় অলিখিত গাড়ি চুরির নিলাম হাট ! তাদের অবিশ্বাস্য কারসাজিতে নিলামের বৈধতা দেখিয়ে সিন্ডিকেট চক্রটি রীতিমতো গড়ে তুলে চোরাই গাড়ির
ব্যবসা। আর এ ব্যবসায় জড়িত হয়ে চশমা তারেকের সম্পৃক্ততায় আদালতের কম্পিউটার অপারেটর আল আমিন এখন বনে গেছেন কোটিপতি।
সম্প্রতি চোরাই গাড়ি উদ্ধার করতে নেমে হবিগঞ্জ আদালতে অলিখিত চোরাই গাড়ির
হাট বসানোর তথ্য পেয়েছে ঢাকার মিরপুর ডিবির গোয়েন্দারা। একটি দৈনিক জাতীয়
গনমাধ্যমের অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য উঠে এসেছে। চোর সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় চুরি হওয়া ১১টি গাড়ি জব্দ করে ডিবি পুলিশ। আর এসব গাড়ি হবিগঞ্জ আদালতে নিলামে বিক্রি হয়েছে বলে দেখানো হয়। এতে গাড়ি চোর চক্রের সিন্ডিকেটের মূল হোতা চশমা তারেক ও ডিবি’র ওসি মানিকের  সহযোগিতায় অলিখিত নিলামের ব্যবস্থা করেন আদালতের সাঁটলিপিকার কাম
কম্পিউটার অপারেটর আল আমিন। এভাবে গাড়ির চুরির নিলাম হাট বসিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা।
জানা যায়, ২০২১ সালের ১৩ মার্চ একটি গাড়ি চুরি মামলায় মাধবপুর উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামের আব্দুল আলীম ইমন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এরপর তার দেয়া তথ্য মতে একই উপজেলার কৃষ্ণনগর থেকে জজ মিয়ার ছেলের উজ্জ্বল ওরফে হৃদয় পাঠান ও অপর এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। এক পর্যায়ে গাড়ি চোরচক্রের মূল হোতা তারেকুল ইসলাম ওরফে চশমা তারেককে গ্রেফতার করে ডিবি। পরে ডিবি মিরপুর জোনের গোয়েন্দারা এই চক্রের কাছ থেকেই ১১টি গাড়ি উদ্ধার করেন। এসব গাড়ি হবিগঞ্জের একটি আদালতে নিলামে দেওয়ার জাল নথিপত্রও উদ্ধার করা হয়। নিলামের জাল নথিপত্র দিয়ে ৫টি গাড়ি চালানোর প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। গাড়িগুলো হচ্ছে, সবুজ রঙের প্রাইভেট কার চেসিস নং এই১১০-৫১৪২৮৯২, সিলভার রঙের প্রাইভেট কার ঢাকা মেট্রো-গ-২৫-৫০৭৪ চেসিস নং এনজেডই১২১-৩২৫৬৪৪২, নীল রঙের প্রাইভেট কার ঢাকা মেট্রো গ-১১-৪৯৬৮ চেসিস নং এসটি ১৯০-০০০৩৩৬৯, সিলভার রঙের প্রাইভেট কার ঢাকা মেট্রো খ-১২- ৭৬৯১ চেসিস নং এনজেডই ১২০৩০৬৭৬৪৭ এবং সিলভার রঙের
প্রাইভেট কার ঢাকা মেট্রো গ-২০-৯৮৮৯ চেসিস নং
ডব্লিউওএলওজেডসিএফ ৬৮৭১০৭০৮৬৩।
শহরের তিনকোনা পুকুরপাড় এলাকায় তারেকের এটি চশমার দোকান রয়েছে। মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে চশমা ব্যবসার আড়ালে গড়ে তোলা হয় চোরাকারবারিদের বিশাল সিন্ডিকেট। চশমা তারেকের বাড়ি মূলত কিশোরগঞ্জে। একসময় তার পরিবার নবীগঞ্জ উপজেলায় বসতি স্থাপন করে। তার বাবার নাম রহমান আলী। এই তারেকুল ইসলামের একসময় কিছুই ছিল না। গাড়ি চুরির টাকায় এখন তিনি কোটিপতি। গাড়ি চুরির মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়েছে। হবিগঞ্জ জেলা সদরে চশমার দোকান থাকায় এ নামেই পরিচিতি পান দুর্ধর্ষ এই গাড়ি চোর। তবে এসব ঘটনায় ধরাছোঁয়ার
বাইরে রয়েছেন হবিগঞ্জের সাবেক ডিবি’র ওসি (সাময়িক বরখাস্ত) মানিকুল ইসলাম মানিক। ওই পুলিশ কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেন
চশমা তারেক। গাড়ি চোর ও মাদক ব্যবসায়ী চশমা তারেক রীতিমতো ডিবি ওসি মানিকুল ইসলামের ওয়্যারলেস কোমরে রেখে নিজেই ওসি
পরিচয় দিতেন। এ বিষয়ে আল আমিন গনমাধ্যমকে বলেন, ‘নিলাম যথাযথ পদ্ধতি মেনে
করা হয়েছে। তারেকুল ইসলাম ওরফে চশমা তারেক অনেক গাড়ি নিলামে নিয়েছেন। এই আদালত থেকে লাখের ওপরে গাড়ি নিলাম করা হয়েছে ওই সময় আমি দুই মাস মালখানার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের স্টেনো টাইপিস্ট ছিলাম। নিলামকে কেন্দ্র করেই তারেকের সঙ্গে আমার পরিচয়। এর আগে আমি তাকে চিনতামই না।’
উজ্জ্বল ওরফে হৃদয় পাঠান বলেন, ‘চশমা তারেকের কাছ থেকে গাড়ি নিলামে নিয়ে তারা ফেঁসে গেছেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তারেক যে তথ্য-উপাত্ত দিয়েছেন, এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। এদিকে গাড়ি চোর সিন্ডিকেটের মূল হোতা তারেকুল ইসলাম ওরফে চশমা তারেক বলেন, ‘প্রতি গাড়ি নিলামের জন্য সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর আল আমিন ম্যাজিস্ট্রেটের কথা বলে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নিতেন। আল আমিন নিজেই নিলামের নথিপত্রে সংশ্লিষ্ট একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নামে স্বাক্ষর করতেন। এ বিষয়ে শায়েস্তাগঞ্জ থানার সাবেক ওসি মোজাম্মেল হোসেন ওই
গনমাধ্যমকে বলেন, ‘হবিগঞ্জের সাবেক ডিবি ওসি (সাময়িক বরখাস্ত) মানিকুল ইসলাম ও চশমা তারেক ছিলেন মুদ্রার এপিট-ওপিঠ। ডিবির
অভিযানে মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যবহৃত যে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার
ধরা পড়ত সেগুলোর বিনিময়ে কোনো মামলা দেওয়া হতো না।’ তিনি বলেন, ‘মাদক চোরাচালানে ব্যবহৃত প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেল
রেখে দেওয়া হতো। মোটরসাইকেল বা প্রাইভেট কারের বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ছেড়ে দেওয়া হতো। শত শত নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল ওসি মানিক তারেকের মাধ্যমেই বিক্রি করেছে।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান ডিআইজি মেহাম্মদ হারুনুর রশীদ বলেন, ‘হবিগঞ্জে অবৈধভাবে চোরাই গাড়ি নিলাম করার প্রক্রিয়া নিয়ে চশমা তারেক যে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন, তা যাচাই- বাছাই করা হচ্ছে। চশমা তারেক স্পর্শকাতর কিছু তথ্য দিয়েছেন, যা তার দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নেই। তার দেওয়া তথ্যগুলো নিয়ে শীর্ষ মহলে কথা বলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।’ (প্রতিবেদক আখলাছ আহমেদ প্রিয়- দৈনিক হবিগঞ্জের সমাচার) –  সূত্র-দৈনিক যুগান্তর

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here