এফআইআর টিভি অনলাইন ডেস্ক : কয়লাভিত্তিক জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যমাত্
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির অবস্থানপত্র উপস্থাপন করেন টিআইবির ক্লাইমেট ফাইন্যান্স পলিসি ইন্টিগ্রিটি প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোঃ মাহফুজুল হক। এসময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং উপদষ্টো-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এবারের কপ সম্মেলনে ২০৫০ সালের মধ্যে ‘নেট-জিরো’ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, কয়লার ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা, প্রতিশ্রুত জলবায়ু অর্থায়ন প্রদান, বর্ধিত স্বচ্ছতা কাঠামো ও প্যারিস রুলবুক চুড়ান্ত করার মতো গুরুত্বর্পূণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। প্যারিস চুক্তি পরবর্তী সময়ে এই বিষয়গুলো নিয়ে সমঝোতায় পৌছানোর জন্য এই সম্মেলনই শেষ সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে আসন্ন কপ-২৬ সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অনুন্নত দেশের জন্য অনুদান আদায়ে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) নেতৃত্বে বাংলাদেশকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে জিসিএফের প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থ ছাড়ে দীর্ঘসূত্রতা বন্ধে সমন্বিত ও কার্যকর দাবি উত্থাপন করতে হবে।
উন্নত দেশগুলোর সমালোচনা করে টিআইবি জানায়, প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত জলবায়ু তহবিল প্রদান বাধ্যতামূলক না করে ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে। ফলে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য প্রয়োজনীয় জলবায়ু অর্থায়ন পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ২০২০ সাল থেকে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা প্রদানে উন্নত দেশগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে জলবায়ু অর্থায়নের প্রধান মাধ্যম জিসিএফ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য ১৯০টি প্রকল্পে ১০ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন করলেও ছাড় করেছে মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার! অভিযোজন এবং প্রশমন খাতে ৫০:৫০ অনুপাত বজায় রাখার কথা থাকলেও সেটি করা হচ্ছে না। সক্ষমতার ঘাটতির কারণে জিসিএফের কঠিন মানদÐ নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় তহবিল পাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের জন্য কঠিন। এই সুযোগে আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জিসিএফ নিবন্ধন নিচ্ছে এবং জিসিএফ প্রদত্ত অনুদানের সাথে ঋণ যুক্ত করে এটিকে একটি লাভজনক বিনিয়োগ হিসাবে ব্যবহার করছে, যা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সংবাদ সম্মেলনে, বিশ্বে কয়লাভিত্তিক জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধিতে শংকা জানিয়ে টিআইবি বলছে দেশগুলো প্যারিস চুক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। জাতিসংঘ পরিবেশ র্কমসূচীর ‘দ্য প্রোডাকশন গ্যাপ রিপোর্ট ২০২১-এর তথ্য উল্লেখ করে সংস্থাটি জানায়, ভারত ও চীনসহ ১৫টি দেশ ২০৩০ সাল নাগাদ জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহার ১১০ ভাগ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে কয়লার উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁিকতে থাকা বাংলাদেশও হাঁটছে এই উল্টো পথে। রামপাল, মাতারবাড়ি, বাঁশখালী প্রকল্পসহ মোট ১৯টি কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে দেশে, যার বড় অংশই আবার উপকূলীয় জেলায়। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬৩ গুণ বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ১১৫ মিলিয়ন টন বাড়তি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করবে। ফলে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম কয়লা দূষণকারী দেশে রূপান্তরিত হবে, যা কার্বন নিঃসরণ কমানো সংক্রান্ত সরকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সাথে সাংঘর্ষিক। এমন বাস্তবতায় ২০২১ সালের পর কয়লা জ্বালানি নির্ভর নতুন কোনো প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থায়ন না করার ঘোষণা প্রদানের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষমাত্রা অর্জনে কার্যকর নীতি ও বিনিয়োগের দাবি জানায় সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ সরকারের করণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরে বলেন, “আমরা মনে করি, বাংলাদেশ যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, তাই ২০২১ সালের পরে নতুন কোনো প্রকার কয়লা জ্বালানি নির্ভর প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থায়ন করবেনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের এই অঙ্গীকার করতে হবে। আমাদের উচিৎ দেওয়ালের লিখন পড়া। আমরা দেখছি যে, অনেক দেশই কয়লানির্ভর জ্বালানি প্রকল্প থেকে সরে আসছে। এমনকি বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ যোগানকারী অন্যতম দেশ চীন ইতিমধ্যেই নিজ দেশের বাইরে এধরণের প্রকল্প বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। তারা সামনের বছর থেকে এধরনের প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না বলেও জানিয়েছে। অন্যান্য অনেক দেশও এটি করছে এবং করতে বাধ্য হচ্ছে।”
জলবায়ু অর্থায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলো কর্তৃক প্রতিশ্রæত বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের অর্থ স্বচ্ছভাবে ছাড় করানোর দাবি জানিয়ে ড. জামান বলেন, “গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) থেকে অর্থছাড় ও প্রকল্প প্রদানে তাদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। জিসিএফ বিভিন্নরকম কৌশলে আমাদের মত দেশগুলোকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করছে। অভিযোজনকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দিয়ে, তারা তাদেও তহবিলকে ঋণ হিসেবে দেওয়ার প্রয়াস নিচ্ছে এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও উৎসাহ দিচ্ছে। জিসিএফ-এর এধরনের অবস্থানের নিন্দা জানানো যেমন আমাদের দায়িত্ব, তেমনি তারা যেন তাদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করে সে বিষয়ে অ্যাডভোকেসিও চালিয়ে যেতে হবে। ”