মাধবপুর উপজেলা কে নিয়ে সারাদেশে চলছে আলোচনা সমালোচনার ঝড় !
বিজিবি কি এমন সাইনবোর্ড টানাতে পারে ?
বাড়ির সামনেই সাইনবোর্ড টানানো। তাতে লেখা ‘মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি’, ‘চোরাকারবারিদের বাড়ি’। শ্রীমঙ্গল থেকে মাধবপুর পর্যন্ত প্রায় দেড়শ বাড়ির সামনে এমন সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এমন উদ্যোগে মাদক ও চোরাচালান ব্যবসা কমে আসবে বলে মনে করছে বিজিবি।
তবে বিজিবি এমন সাইনবোর্ড টানাতে পারে কি না কিংবা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই কাউকে অপরাধী আখ্যা দিতে পারে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিষয়টি নিয়ে আইনজীবী ও সুজন কর্মীরা মনে করেন, এটি আইন বহির্ভূত কাজ করা হয়েছে এবং মানবাধিকার ও লঙ্ঘন হয়েছে। গত বুধবার থেকেই অনেকেই বিজিবির এমন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। তবে, আইন জেনেই এই কাজে নেমেছেন বলে দাবী বিজিবি অধিনায়কের।
বিজিবি বলছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দীর্ঘদিন ধরে মাদক ও চোরাচালানের সাথে জড়িত রয়েছে কয়েকটি চক্র। বিভিন্ন কৌশলে ওই চক্রগুলো বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে তাদের অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে আসছে। বিভিন্ন সময় তাদেরকে আটক করে মামলা দিলেও কারাগার থেকে বেরিয়ে পুনরায় তারা এই ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পরছেন।
বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেও মাদক এবং চোরাচালান বন্ধ করা যায়নি। অবশেষে অবৈধ এসব ব্যবসায়ীকে সমাজের কাছে চিহ্নিত করে দিতে বাড়ির সামনে সাইন বোর্ড লাগানোর উদ্যোগ নেয় বিজিবি।
তাদের তথ্যমতে, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে মাধবপুর সীমান্ত পর্যন্ত অন্তত দেড়শ’ বাড়িতে এমন সাইনবোর্ড সাঁটানো হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কোন বাড়ির সামনে ‘এটি মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি’ আবার কোনটিতে ‘এটি চোরাকারবারির বাড়ি’ লেখা সাইনবোর্ড রয়েছে। লাল রঙের সাইনবোর্ডের ওপর সাদা অক্ষরগুলো দূর থেকেই পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে সিলেটের পরিবেশ কর্মী আব্দুল করিম কিম লিখেন, ‘এ যেন মগের মুল্লুক! ভয়াবহ রকমের মানবাধিকার লঙ্ঘন। মাদক ব্যবসায়ী হোক, চোরাকারবারি হোক আর ডাকাত হোক কারো বাড়িকে এভাবে চিহ্নিত করে সমাজের কাছে আজীবনের জন্য দণ্ডিত করা কোন বিচারেই ন্যায় সংগত নয়। এইভাবে একজনের অপরাধের জন্য ঐ বাড়ির সকলকে হেয় করার তীব্র নিন্দা জানাই। এই ধরনের অপকর্ম রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে শুরু করা মানে ভবিষ্যতে আয়ের চেয়ে অর্জিত সম্পত্তি বেশী থাকার কারণে জনগণ সরকারী কর্মকর্তাদের বাড়িতে সাইনবোর্ড লাগানো শুরু করবে ‘দুর্নীতিবাজের বাড়ি’ ‘ঘুষখোরের বাড়ি’ নামকরণ করে।
বিজিবি-৫৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক এসএনএম সামীউন্নবী চৌধুরী বলেন, ‘শ্রীমঙ্গল উপজেলা থেকে চুনারুঘাট হয়ে মাধবপুর সীমান্ত পর্যন্ত আমার অধীনে। এই জায়গাগুলোতে অন্তত দেড়শ’ বাড়িতে এমন সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে বিজিবির মামলা রয়েছে তাদেও বাড়িতেই মূলত সাইনবোর্ডগুলো লাগানো হয়েছে। পুলিশের মামলাকে আমরা ক্রাউন্ট করিনি।’
তিনি বলেন, ‘অনেক চেষ্টার পরও তাদের অপরাধ জগত থেকে বের করা যাচ্ছে না। তাই সামাজিকভাবে চাপের মুখে থাকলে অপরাধমূলক কাজ ছেড়ে দিতে পারে, এই চিন্তা থেকেই সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বা তারা এ ব্যবসা থেকে সড়ে আসলে সাইনবোর্ডগুলো খুলে নেয়া হবে।’
সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব সমালোচনায় আমি কান দেই না। আমি আইন শক্ত করেই এই কাজে নেমেছি। সুতরাং সমালোচনায় কিছু আসে যায় না।’
একজনের জন্য পুরো পরিবার কেন চিহ্নিত হবে ? প্রশ্নর জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিবারের ওই সদস্য কেন মাদক বা চোরাচাকারবারের সাথে জড়িত। এই দায় পুরো পরিবারের ওপর পরে।’
এই বিষয়ে ‘এটা মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি, চোরাকারবারির বাড়ি, ডাকাতের বাড়ি এভাবে চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড লাগানো আইনের কোন বৈধতা নেই। অপরাধ কর্মকাণ্ডের স্থানগুলো চিহ্নিত করতে পারে। এভাবে বাড়ি-ঘর চিহ্নিত করা এক কথায় আইনের ব্যত্যয়। এটা করতে হলে সংসদের আইন পাশ করতে হবে।’
এ বিষয়ে হবিগঞ্জের আইনজীবী এম এ মজিদ বলেন, ‘আইনে এমন কার্যক্রমের কথা বলা নেই। কোর্টও এমন আদেশ কখনো দেয় না। অপরাধ করে থাকলে ব্যক্তি করেছে, তার মানে এ দায় পরিবারের নিতে হবে এমন কোন কথা নয়।’
সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট হাফিজুল ইসলাম বলেন, এমন অপমান ওই পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আর একজনের অপরাধের শাস্তি যদি পুরো পরিবার পায়, তাহলে সমাজ এবং রাষ্ট্রকেও এর দায় নিতে হবে। সীমান্তে চোরাকারবারি ঠেকাতে না পারার ব্যর্থতার দায় কি বিজিবির নেই?’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) হবিগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন বলেন, ‘বিষয়টি সম্পূর্ণ মানবাধিকার বিরোধী। এটি সারা জীবন মানুষের মনে থাকবে। পরবর্তীতে ওই পরিবারের ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্যও অনেক সমস্যা হবে।’