এফআইআর টিভি অনলাইন ডেস্কঃ দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন, বেকারের বোঝা, জনগণের নাভিশ্বাস, নিরাপত্তাহীন জান-মাল। বৈষম্য আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ভোট, গণতন্ত্র, সবার অংশগ্রহণ, সুশাসন- এসবই এখনও অধরা। এমনই এক জাতীয় প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া ও ডাকসুর সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নুর নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিয়েছেন। স্লোগান তুলেছেন ‘জনতার অধিকার আমাদের অঙ্গীকার’। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ- এই চার মূলনীতি নিয়ে দলের নাম দিয়েছেন বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ।
প্রথমত, গণঅধিকার পরিষদ হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা কোনো গোষ্ঠী নয়। গণঅধিকার পরিষদ গড়ে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবার অধিকারের জন্য দেশের তরুণরা ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে লড়েছিল; আক্রান্ত হয়েছিল। একটি সফল, সুসংগঠিত সামাজিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত হয়েছিল এই দলের রাজনৈতিক ভিত্তি। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়েই এই রাজনৈতিক শক্তি তার সম্ভাবনার ইঙ্গিত করেছিল। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামের সেই সামাজিক আন্দোলনটিই ধাপে ধাপে মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে মিল রেখে আজ পুরোপুরি ‘রাজনৈতিক দল’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
দ্বিতীয়ত, তারুণ্যনির্ভর এ দলের রাজনীতির সঙ্গে মানুষের প্রত্যাশার সংযোগের আরেকটি দিক হলো- এ দল রাজনীতিকে অভিজাত শ্রেণীর বেড়াজাল থেকে বের করে, তাতে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এক কথায় গণঅধিকার পরিষদ রাজনীতিকে ‘ডি-এলিটাইজেশন’ করতে ভূমিকা রেখেছে। এ দলের মূল চরিত্র নুরুল হক নুর গ্রাম থেকে উঠে আসা মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা বরাবরই কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে উপেক্ষিত হয়ে আসছে। ফলে এ দলে যারা এসে যুক্ত হয়েছে তারা এলিট শ্রেণীর অতিথি কক্ষ থেকে রাজনীতি চর্চাকে গণমানুষের ঘর-গৃহস্থালীতে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। দু’একটি উদাহরণ দিলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। অধিকার পরিষদের দল গঠনের প্রক্রিয়া চলাকালে সিরাজগঞ্জের যুবক কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসেছিল ভিপি নুরের সঙ্গে দেখা করতে। সে জানিয়েছে, সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তার হাতে ছিল না। সে তিন দিন ইট ভাঙার কাজ করে অর্থ সংগ্রহ করেছে। তারপর সেই অর্থে আরও দুইজন কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এসেছে নেতার সঙ্গে দেখা করতে।
তৃতীয়ত, এ রাজনীতি গতানুগতিক কোনো মহান ব্যক্তির চমকের (Great Man’s Charisma) ওপর গড়ে ওঠেনি। ব্যক্তির চিন্তাকে পুঁজি করে, সেটাকেই আদর্শ হিসেবে প্রচার করে রাজনীতির নামে ব্যক্তিপূজা বা পরিবারতন্ত্রের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এ দল। একক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা কাঠামো বিকাশের বিরুদ্ধে ভারসাম্য স্থাপনের কথা ঘোষণা করেছে। ফলে কার্যতই এ দল সত্যিকারের গণমানুষের দল হয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই রাজনীতির ভ্রুণ সৃষ্টি হয়েছিল সে আন্দোলনকেও এককভাবে কোনো গ্রেটম্যানের ক্যারিশমা বলা যায় না। বরং বৈষম্যের শিকার হওয়া শিক্ষিত তরুণদের সমন্বিত উদ্যোগই (Collective Action) আন্দোলনের মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। পরে সেই সমন্বিত উদ্যোগের মধ্য দিয়েই সাহস ও অদম্য মানসিকতার বলে বিকশিত হয়েছিল নুরুল হক নুরের মতো নেতা। অর্থাৎ এ রাজনীতি মূলত গ্রেটম্যান আর সমন্বিত উদ্যোগ- এই দুয়ের সমন্বয় ঘটিয়েছে।
চতুর্থত, গণঅধিকার পরিষদের দল গঠনের প্রক্রিয়া চলাকালে নানা সংশয় ছিল এ দলের অবস্থান নিয়ে। অনেকেই বলছিলেন, বামপন্থিদের সঙ্গে মিশে ভিপি নুরেরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। আবার বিপরীত দিকের অভিযোগ ছিল, ভিপি নুর সংখ্যাগরিষ্ঠের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ডানপন্থি রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সবশেষে রাজনৈতিক দলও কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে গণঅধিকার পরিষদ ডান-বামের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার আর জাতীয় স্বার্থকে মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করতে পেরেছে। এ কারণেই এ দল ‘রাজনীতিতে ইতিবাচক সংস্কারের’ নতুন মডেল হিসেবে গণমানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে সক্ষম হওয়ার আশা জাগিয়েছে।
তবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, সদ্য ঘোষিত দলের সামনে চ্যালেঞ্জ থাকবেই। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নতুনের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মেধা ও যোগ্যতার সমন্বয় ঘটিয়ে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা। দলের রাজনৈতিক চিন্তা ও বিকাশে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে পারা আর সময়ের দাবিকে উপলব্ধি করতে পারা। ড. রেজা কিবরিয়ার মতো বিশ্বমানের অর্থনীতিবিদকে দলের আহ্বায়ক হিসেবে যুক্ত করতে পারা এই ক্ষেত্রে অগ্রগতির নির্দেশক। প্রকৃত সাফল্য ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
লেখক: গবেষক ও বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক