সংবাদ বিজ্ঞপ্তিঃ পরিবেশ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা ও প্রয়োগের ব্যর্থতা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের অনিয়মসহ সুশাসনের সকল সূচকে ঘাটতির কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে। এর ফলে একটি দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অনেকাংশে অক্ষম ও অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিণত হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। ‘পরিবেশ অধিদপ্তরে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একই সঙ্গে সংকট উত্তরণে দশ দফা সুপারিশ প্রদান করেছে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন বিষয়ক রিসার্চ ফেলো মো. নেওয়াজুল মওলা। এই গবেষনাটি তত্ত্বাবধান করেছেন একই বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলম।
গবেষণায় দেখা গেছে, আমলা-নির্ভরতা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও নীরিক্ষায় ঘাটতি, পেশাগত দক্ষতার অভাবসহ পরিবেশ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের দুর্বলতার পাশাপাশি আইনের কার্যকর প্রয়োগেও ব্যর্থ হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কর্মীদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অংকের নিয়ম-বহির্ভূত আর্থিক লেনদেন এবং তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ঘাটতির ফলে পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। অধিদপ্তরের কর্মীদের একাংশের সাথে পরিবেশ দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের একাংশের যোগসাজশ এবং তাদের প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করার কারণে অধিদপ্তরের কার্যকরতা ব্যাহত হচ্ছে। অধিদপ্তরের কার্যক্রমে সুশাসনের বিভিন্ন নির্দেশক যেমন- স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, জনসম্পৃক্ততা এবং কার্যকর সমন্বয়ে ঘাটতি বিদ্যমান। একদিকে সামর্থ্যের ঘাটতি এবং অন্যদিকে সরকারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়ে বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণে ঘাটতিই ব্যর্থতার মূল কারণ। এছাড়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ সরকারি বিভিন্ন বড় উন্নয়ন প্রকল্প এবং শিল্প কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার কার্যক্রমের অংশ হওয়ার কথা থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের বিদ্যমান ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যর্থতা লক্ষণীয়।
এপ্রিল ২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিশ্র পদ্ধতিতে গবেষণাটি করা হয়েছে। ৩০ টি মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার গ্রহণ, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং প্রধান ও মাঠ পর্যায়ের ৭টি কার্যালয় পর্যবেক্ষণ এবং ৩ শত ৫৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপের মাধ্যমে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করে আইনের শাসন, সক্ষমতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, অংশগ্রহণ, কার্যসম্পাদন, সমন্বয় ও অনিয়ম-দুর্নীতি-এ আটটি সূচকের আলোকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, পরিবেশ সংশ্লিষ্ট আইন, নীতি ও বিধিমালা প্রতিপালনে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর ৩(২) ধারা অনুযায়ী অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিয়োগের কথা বলা হলেও, নিয়োগে চাকুরির শর্ত-যোগ্যতা, পরিবেশ সম্পর্কিত বিশেষায়িত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নির্ধারণ না করায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের সুযোগ রয়েছে এবং বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন নেতৃত্বের ঘাটতিও পরিলক্ষিত হয়। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ এর ধারা ৫-এর যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় কৃষি ও উর্বর জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ইট তৈরি চলমান থাকায় মাটি উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। এছাড়া, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭-এ ক্ষেত্রবিশেষে আন্তর্জাতিকভাবে অনুসৃত মাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মাত্রা নির্ধারণ না করায় হয়নি। এছাড়া আবাসিক এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপন না করার নির্দেশনা থাকলেও পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদান অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে, সকল শ্রেণির শিল্প কারখানার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থেকে অনাপত্তিপত্র ছাড়াই পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র প্রদান করা হচ্ছে।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরে ১ হাজার ১ শত ৪১টি পদের বিপরীতে ৬ শত ৭৬ টি পদে লোকবল শূণ্য থাকায় ছাড়পত্র প্রদানসহ অন্যান্য সেবা প্রদানে সমতা নিশ্চিত করা যায় না, যা অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে। তদারকি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করার জন্য অধিদপ্তরের নিজস্ব ক্ষেত্রভিত্তিক বিশেষজ্ঞ দল নেই। আধুনিক পরিবেশগত ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের ঘাটতি থাকায় প্রায়শ দূষণ বা পরিবেশগত বিপর্যয় দ্রুত চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রেও ঘাটতি রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কিত বিশেষায়িত জ্ঞান-অভিজ্ঞতা এবং পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বড় উন্নয়ন প্রকল্প এবং শিল্প কারখানা স্থাপনে ছাড়পত্র প্রক্রিয়ায় বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণে ঘাটতি রয়েছে।
মাত্র ২১টি জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয় থাকার কারণে কোনো কোনো কার্যালয়কে একই সাথে ৩-৪টি জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। এছাড়া, পরিবেশ অধিদপ্তরের অবকাঠামোগত ও লজিস্টিকসের ঘাটতি রয়েছে। পরিবেশগত ছাড়পত্র আবেদন পদ্ধতি অনলাইনভিত্তিক করা হলেও প্রদান ও নবায়ন সম্পূর্ণভাবে ডিজিটালাইজড করা হয়নি। পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ কর্মকা- পরিচালনাসহ তদারকি ও পরিবীক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তির ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া, অধিদপ্তরের কার্যক্রমে জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) ও রিমোট সেনসিং প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করা হয়নি। ম্যানুয়ালি কর্মকা- পরিচালনা করায় পরিবেশ অধিদপ্তর সঠিকভাবে দূষণের মাত্রা শনাক্ত করতে পারে না।
আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরিবেশ অধিদপ্তরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়া সত্ত্বেও এ খাতে প্রতিষ্ঠানটি বরাদ্দের সম্পূর্ণ অংশ খরচ করতে পারে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের জন্য গত পাঁচ অর্থবছরে গড় বরাদ্দ ছিলো ৯৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা; পক্ষান্তরে গড় ব্যয় ছিলো ৮৫ কোটি টাকা। পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজস্ব সংগ্রহে আগ্রহ বেশি থাকায় তা পরিবেশ রক্ষায় অন্যতম অন্তরায় ও দুর্নীতির ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান ও নবায়ন ফি আদায় আয়ের অন্যতম উৎস হওয়া সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে অধিদপ্তর এর আওতায় নিয়ে আসতে পারেনি। এছাড়া, পরিবেশ অধিদপ্তরে তথ্যের উন্মুক্ততা ও স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ঘাটতি বিদ্যমান। ওয়েবসাইটে অধিদপ্তরের পূর্ণাঙ্গ বাজেট, প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য, প্রতিবছর বিভিন্ন পর্যায়ে কী পরিমাণ দূষণ হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে ও কারা করছে তা প্রকাশ করা হয় না। কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইটটি নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না এবং গত ছয় বছরেও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যচিত্র হালনাগাদ করা হয় নি। দেশের বৃহৎ প্রকল্পসহ (যেমন রামপাল, মাতারবাড়ি, পদ্মাসেতু ইত্যাদি) সব ধরনের প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (ইআইএ) প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় না।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে তদারকির সময় তদারকি কর্মকর্তা ইটিপি, কারখানার পরিবেশ, পানির মান, লাইসেন্সের কাগজপত্র, ল্যাবরেটরি রিপোর্ট, টাকার রশিদ, ছাড়পত্র নবায়ন ও মূল সার্টিফিকেট ইত্যাদি বিষয় সংশ্লিষ্ট কারখানার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সঠিকভাবে তদারকি করেন না। জরিপের আওতাভুক্ত প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিল্পকারখানায় বছরে একবারও পরিবেশ অধিদপ্তরের তদারকি হয়নি। এছাড়া, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার তদারকিতে ঘাটতি থাকায় পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান ও নবায়ন ছাড়পত্র হস্তান্তর করতে সময়ক্ষেপণ করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ছাড়পত্র নিতে দালালের মাধ্যমে কাজ স¤পন্ন করতে গিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা হয়রানির শিকার হয়। অন্যদিকে, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয় কর্তৃক পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে যথাযথ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।
দেখা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে প্রতি মাসের তৃতীয় বৃহ¯পতিবার গণশুনানি অনুষ্ঠিত হলেও এর কার্যকরতায় ঘাটতি রয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পরিবেশগত বিপন্নতা ও পরিবেশের ক্ষয়-ক্ষতি সম্পর্কে স্থানীয় জনগণের মতামত পরিবেশগত সমীক্ষাতে (আইইই, ইআইএ এবং এসআইএ) প্রতিফলিত হয় না। অভিযোগ আছে, ইটিপি থেকে নির্গত পানির মান সঠিকভাবে নির্ণয় করা হয় না। পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার পরে ‘মিটিগেশন মেজার’ পরিকল্পনা দিয়েও কোনো প্রকল্পের ঝুঁকি নিরসন না হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, তা বাতিল করার নিয়ম থাকলেও সরকারি বড় প্রকল্প ও বিনিয়োগের শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে এই নিয়মের প্রয়োগ হয় না। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৪ কি.মি. দূরে সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা এবং ২.৫ কি.মি. দূরে বিপন্ন প্রজাতির ইরাবতী ডলফিনের অভয়ারণ্যের ক্ষতি রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে দূষিত রাজধানীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে হলেও দূষণ বন্ধে অধিদপ্তর সুরক্ষামূলক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, জরিপকৃত শিল্প কারখানার শতকরা ৫১ ভাগ মেয়াদোত্তীর্ণ ছাড়পত্র দিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যার শতকরা ৭০ ভাগ তথ্য সংগ্রহের সময় পর্যন্ত নবায়নের জন্য আবেদনই করেনি। অন্যদিকে, দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের কোনো তালিকা না থাকায় ‘দূষণকারী কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রদান’ মানদণ্ডের আলোকে জরিমানা, দণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণে ঘাটতি রয়েছে। দূষণকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালতে মামলা করার পরিবর্তে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে জরিমানা নির্ধারণে অধিদপ্তর বেশি আগ্রহী বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে দায়ের করা মামলার বাইরেও ফৌজদারি আইনের মামলার বোঝা রয়েছে পরিবেশ আদালতের ওপরে।
এছাড়া, জরিপের আওতাভুক্ত শতকরা ১৭ ভাগ শিল্প কারখানা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট হতে অনাপত্তিপত্র না পাওয়া সত্ত্বেও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। আবাসিক এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপন না করার আইনি বিধান থাকলেও বেশিরভাগ শিল্প কারখানাই (৭২ শতাংশ) আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ক্ষেত্রবিশেষে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে এটি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবেশ দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সাথে প্রভাবশালী আমলা এবং ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের একাংশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক থাকায় প্রভাব এবং যোগসাজশের মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ ইআইএ সম্পাদন করেও ছাড়পত্র দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য কোনো কোনো কর্মকর্তার সাথে দালালের পূর্ব যোগসাজশ এবং নিয়ম-বহির্ভূত অর্থের একটা অংশ প্রাপ্তির পর ছাড়পত্র প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। জরিপে শতকরা ৫১ ভাগ শিল্প কারখানায় পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। জরিপের আওতাভুক্ত শতকরা ৫৭ ভাগ শিল্পকারখানা/প্রকল্প কোনো প্রকার পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ছাড়াই পরিবেশগত ছাড়পত্র পেয়েছে। জরিপকৃত শিল্প কারখানার শতকরা ৬৬ ভাগ পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে (যেমন অনাপত্তিপত্র পাওয়া, অবস্থানগত ছাড়পত্র পাওয়া) যোগসাজশের মাধ্যমে নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন করে থাকে। পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে শ্রেণিভেদে সার্বিকভাবে সর্বনিম্ন ৩৬ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৮ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ম বহির্ভূত আর্থিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
এছাড়া, অধিদপ্তরের ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ প্রকল্পের অধীনে অযৌক্তিকভাবে একই কর্মকর্তার ১০ বারসহ ১০ বছরে মোট ২৯৩ জন কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে ভ্রমণ বাবদ অর্থ অপচয় করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মীদের একাংশের ক্ষমতা অপব্যবহার করে এবং অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জরিমানার অর্থ মওকুফ করে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। কারখানায় ইটিপির কার্যকরতা তদারকির সময় অধিদপ্তরের কর্মীদের একাংশের পারষ্পরিক যোগসাজশে এবং নিয়ম বহির্ভূত অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে ইটিপি অচল/বন্ধ রাখা হয় ও জরিমানা করা হয় না। পরিবেশ অধিদপ্তরের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় অন্যতম অন্তরায় হিসেবে প্রভাবশালীদের হুমকি, হস্তক্ষেপ এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মৌখিক নির্দেশনা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আইন ও বিধিমালা দ্বারা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে পরিবেশ অধিদপ্তর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সুশাসনের যতগুলো সূচকে আমরা গবেষণাটি করেছি তার সবগুলোতেই ঘাটতি পরিবেশ অধিদপ্তরকে জর্জরিত করেছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ পরিবেশ দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে যোগসাজসের মাধ্যমে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে প্রতিষ্ঠানটি একটি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি এক ধরনের বিপরীতমুখী ভূমিকা পালন করছে। অর্থাৎ সর্ষের মধ্যেই ভূতের দেখা মিলছে। অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও সুশাসনের ঘাটতি দূর করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনা, প্রভাবশালী শিল্প কারখানার মালিকদের প্রভাব থেকে মুক্ত করে পরিবেশ অধিদপ্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে পরিবেশ দূষণ ও এর বিপর্যয় থেকে উত্তরণে ব্যর্থতার পাশাপাশি এ সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন সম্ভব হবে না।”
সার্বিক বিবেচনায় পরিবেশ অধিদপ্তরে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে দশ দফা সুপারিশ প্রদান করেছে টিআইবি, উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ হলো- আইনের যথার্থ প্রয়োগে ভয়, চাপ ও আর্থিক প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে দৃঢ়তার সাথে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী বড় উন্নয়ন প্রকল্প এবং শিল্প কারখানাগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা; প্রেষণে পদায়ন না করে অধিদপ্তরের নেতৃত্বে বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া; যথাযথ চাহিদা নিরূপণসাপেক্ষে সকল কার্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো, কারিগরি ও লজিস্টিক্যাল সুবিধা নিশ্চিত করা; প্রকল্প বাস্তবায়ন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ সংরক্ষণের সাথে জড়িত সকল কর্মীর বাৎসরিক আয় ও সম্পদের বিবরণী বছর শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়াসহ তা প্রকাশ করা ইত্যাদি।