এম এ কাদেরঃ হবিগঞ্জ জেল কারাগারে অনিয়ম ও দুর্নীতি আদি যুগের বর্বরতা’কেও হার মানায়। নিয়মনীতি’কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে রমরমা বানিজ্য। অসাধু কিছু কারারক্ষীদের দ্বারা প্রবেশ করছে অবৈধ মরন নেশা মাদক! বন্দীদের দেওয়া খাবার কুকুরও খাবেনা। স্তরে স্তরে চলছে বানিজ্যের মহা তান্ডব। বন্দীদের ন্যায্য অধিকার থেকে নিয়মিত হচ্ছে বঞ্চিত। যে কোন অপরাধীদের আত্মশুদ্ধি বা শোধরানোর জায়গা হল কারাগার। প্রত্যেক আসামির জন্য কারাগার হল এক জীবণ সংগ্রামের পথ প্রদর্শক। অথচ সেই কারাগারে চলছে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ অপরাধমূলক কর্মকান্ড। তারই সত্যতা মিলেছে হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে। হবিগঞ্জ কারাগার যেন অনিয়মই নিয়মনীতি।
“খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো,
বর্গি এলো দেশে। বুলবুলিতে
ধান খেয়েছে, খাজনা দিবো কীসে?”
কারা অধিদপ্তর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনস্ত একটি প্রতিষ্ঠান, যা দেশের ৬৮ টি কারাগার তথা এর কর্মকর্তা – কর্মচারী ও বন্দিদেরকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক হন। কর্ণেল পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা কারা অধিদপ্তরে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। কারা অধিদপ্তরের অধীনে ০৮ (আট) টি বিভাগে তথা বিভাগীয় সদর দপ্তরে আট জন কারা উপ-মহাপরিদর্শক রয়েছেন। এ আটটির মধ্যে কারা উপ-মহাপরিদর্শক, ঢাকা বিভাগ, ঢাকার অধীনে সতেরটি কারাগার। কারা উপ-মহাপরিদর্শক, ময়মনসিংহ বিভাগ, ময়মনসিংহের অধীনে আছে চারটি কারাগার। কারা উপ-মহাপরিদর্শক, রাজশাহীর অধীনে আটটি কারাগার, এবং রংপুর বিভাগে আটটি কারাগার রয়েছে। এগারটি কারাগার নিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগ গঠিত, যার বিভাগীয় সদর দপ্তর চট্টগ্রামে অবস্থিত। সিলেট বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শকের কার্যালয়ের অধীনে ০৪ টি কারাগার রয়েছে । খুলনা ও বরিশাল বিভাগে যথাক্রমে দশটি ও ছয়টি কারাগার অবস্থিত। বাংলাদেশে বর্তমানে ৬৮টি কারাগার রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ৫৫টি জেলা কারাগার। কেন্দ্রীয় কারাগারে সিনিয়র জেল সুপার সংশ্লিষ্ট কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জেলা কারাগারে জেল সুপার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও প্রতিটি কারাগারে জেলার চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, এবং ডেপুটি জেলার সহকারী এক্সিকিউটিভ অফিসার ও সার্জেন্ট ইন্সট্রাক্টর, সর্বপ্রধান কারারক্ষী, প্রধান কারারক্ষী, সহকারী প্রধান কারারক্ষী, কারাররক্ষীগণ সার্বিক কারা নিরাপত্তাসহ উর্ধতন এর নির্দেশনাসমূহ যথাযথ পালনের জন্য সহযোগিতা করে থাকেন। সিলেট বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শকের কার্যালয়ের অধীনে ০৪ টি কারাগার রয়েছে ।
আর চারটি কারাগারে মধ্যে হবিগঞ্জ কারাগার হল দুর্নীতি ও অনিয়মের মহাসেরা। সীমাহীন অনিয়ম এবং দুর্নীর
অপর নাম হবিগঞ্জ কারাগার। ‘রাখিব নিরাপদ দেখাব আলোর পথ’ কারা কর্তৃপক্ষের স্লোগান হলেও তা বাস্তবতার সাথে কতটা মেলে? কারাগারে জেল হত্যার মতো ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি দুর্নীতি আর অনিয়মের আখড়া হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে৷
প্রকৃতপক্ষে সেখানকার দায়িত্বশীল কিছু কর্মকর্তারা নানাভাবে দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে কারাগারটিকে। কারা অভ্যন্তরে মাদক বাণিজ্য ও মাদক সেবন, বন্দি বেচা কেনা, জুলুম করে অন্যায় ভাবে অর্থ আদায়, ফোন কল বেচাকেনা, ক্যান্টিনে আয়ের বড় অংশ হল চড়া দামে মালামাল বিক্রয় করা, ওষুধ বেচাকেনা হাসপাতালে ভর্তির নামে মোটা অংকের অনৈতিক লেনদেন এমনকি বন্দীদের খাবারের অংশ বাইরে বিক্রি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা অহরহ ঘটছে এ কারাগারে। সম্প্রতি কারাগার থেকে বের হওয়া একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়। ১৫ টাকা গ্যাসলাইট ১২০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এমনি করে প্রতিটি দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতিতে বিক্রি করা হচ্ছে হবিগঞ্জ কারাগার ক্যান্টিনে।
জানা যায় কারাগারের ভিতরে ক্যান্টিনে মাছ মাংস, সিঙ্গারা, লুচি, পিয়াজু, পরটা, চানাবুট দিয়ে তৈরি বিরানী, সবজি তরকারি, ফলমূল সহ আরো অনেক কিছু বিক্রি হয় চড়া দামে। এগুলো বিক্রি করে প্রকৃতি আয় গোপন করে সরকারি হিসাবে দেখানো হয়। এগুলো কারা কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, কারাগারের ভেতরের ক্যান্টিনে প্রতিমাসে ৩৫ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা বেচা কেনা করা হচ্ছে।
অপর একটি সূত্র জানায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবসে বন্দীদের জন্য সরকারি ভাবে ভালো মানের বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও কারা কর্তৃপক্ষ এক সপ্তা অংশ থেকে প্রতিদিনের খাবারের তালিকা থেকে খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয় চুরি করার মত একটি কাজ করে থাকেন খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করে।
কারাগার সূত্র জানায়, হবিগঞ্জ কারাগারে বর্তমানে প্রায় এক হাজার বন্দি বসবাস করে।
সাধারণত আসামিরা মামলায় হাজিরা দিতে গেলে লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে মাদক সংগ্রহ করে। নিজেরা সেবন করে এবং অন্যদেরকে অর্থের বিনিময় প্রদান করে কারাগারে ভিতরে মাদকের ব্যবসা করে।
বর্তমান সময়ে কোন আসামিকে আদালতে নেওয়া হয় না, দেশের পরিস্থিতির উপর বৃত্তি করে। এছাড়া কারাগারে অনেক কর্মচারী কারাগারের বাইরে থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে তা কারাগারে ভেতর বিক্রি করা মাদকের সয়লাব করে নিজের পকেট ভারি করে চালিয়ে যাচ্ছে রমরমা বানিজ্য।
বিশেষ করে কারাবাগানে দায়িত্বরত কারারক্ষী রুবেল দেব এর সহযোগিতা কারা অভ্যন্তরে মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে ইয়াবাসহ নানা প্রকার মাদক। কারা অভ্যন্তরে মাদকের প্রতিবাদ করলে, কারারক্ষী রুবেল দেব এর রোষানলের শিকার হতে হয়। কারাগারে মাদক যায় দুভাবে। একটি হচ্ছে কারাগারে কর্মরতদের মাধ্যমে, অন্যটি হচ্ছে কারাগারের উত্তর ও দক্ষিণ পাশের দেয়ালের ওপারে সামনে থেকে মাদক ছুড়ে ভেতরে পাঠানো হয়।কাগজ বা পলিথিনের মধ্যে গাঁজা, ইয়াবার সঙ্গে ঢিল তুলে হাজতির নাম লেখা চিরকুটসহ তা ছুড়ে মারা হয় কারাগারের মধ্যে। কারাগারের অভ্যন্তরে দায়িত্ব পালনকারী কারারক্ষীরা রুবেল দেব তা পেয়ে হাজতিদের কাছে টাকার বিনিময়ে পাঠিয়ে দেন।
বন্দীদের স্বাক্ষাৎএ অনিয়ম থামছে না।
নগদ টাকা ৩’শ থেকে ৫’শ অথবা তিন পেকেট সিগারেট বিনিময়ে বন্দীদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাত এবং অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তার সাথে জড়িয়ে রয়েছেন দায়িত্বরত কারারক্ষী, স্বাক্ষাৎ টেবিলের হাজতি রাইটার উজ্জ্বল ও মনির।
অন্যদিকে কারাবন্দীদের ফোন কল নিয়েও রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। ফোন কলের দায়িত্ব থাকা কারারক্ষী মোঃ জিয়া প্রতি মিনিটে ১’শ টাকা থেকে ৫’শ টাকা আদায় করে আসছেন। যে সব বন্দীদের কাছে নগদ টাকা নেই, তাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে তিন থেকে চার পেকেট সিগারেট। শুধু তা-ই নয় জিয়ার মোবাইল ফোনে বিকাশেও প্রবেশ করছে হাজার হাজার টাকা। যা বন্দীদের আত্মীয় স্বজনরা দিয়ে থাকেন। শুধু মাত্র কথা বলার সুযোগ সুবিধা ভোগ করার জন্য।
কারাগারে খাবারের মান খুবই নিম্নমানের বলে জানিয়েছেন একাধিক হাজতি। সকালে রুটির সঙ্গে পেঁপে অথবা লাউয়ের পাতলা ঝোল দেওয়া হয়। রুটিও খুব পাতলা। দুপুরে লাউ, মিষ্টি কুমড়ো, কচু, পুইশাক অথবা পেঁপে’র পাতলা ঝোলের সবজি। আর রাতে ভাতের সাথে ছোট আকৃতির এক পিস সিলভার কার্প বা তেলাপিয়া নয়তো পাঙ্গাস মাছ। এবং পুরোনো সবজি থাকে নিয়মিত। একাধিক বন্দি জানান, তালিকায় রুই, কাতলাসহ বিভিন্ন মাছ খাওয়ানোর কথা থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই দেওয়া হয় পুকুরে চাষ করা পাঙাশ, তেলাপিয়া ও বিভিন্ন কার্পজাতীয় মাছ। আর মাঝেমধ্যে যে মাংস খাওয়ানো হয়, তা-ও পরিমাণে খুব কম।
এদিকে কারাগারে ঘটে যাওয়া সকল অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য অধিদপ্তরে জানানোর দায়িত্বে থাকা কারারক্ষী সদস্য এখনও নাকে তৈল দিয়ে ঘুমের ঘরে বাস করছে। সে প্রতিমাসে কাড়ি কাড়ি টাকা কামানোর আসায় সঠিক দায়িত্ব পালনে বিমূখ। এভাবেই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে হবিগঞ্জ জেলা কারাগার।
কারাগারে এত দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয় জেলা’র মাসুদের সাথে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি কোন ফোন কল রিসিভ করেনি।
এ বিষয়ে জানতে জেল সুপার মতিয়ার এর সাথে বার বার মোবাইল ফোনে ও ক্ষুদেবার্তায় যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি কোন সাড়াদেননি।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক জিলুফা সুলতানা’র সহীত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ধন্যবাদ তথ্য দেয়ার জন্য। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করে অবহিত করার জন্য জেল সুপার কে বলা হয়েছে।
এছাড়া এইসব ব্যাপারে সিলেট বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্স মোঃ ছগির মিয়ার সাথে মুঠোফোন যোগাযোগ করে কারা অভ্যন্তরের বিষয় অবগত করার পর তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমি বিষয় গুলো ক্ষতিয়ে দেখে ব্যবস্হা গ্রহন করব।
হবিগঞ্জ কারাগারের এত দুর্নীতি রুখবে কে? শিরোনামে আসছে ২য় পর্বে আরো অনিয়ম ও দুর্নীতির লোমহর্ষক ভয়ংকর তথ্য।